নিউক্লিয়ার ফিউশন: ভবিষ্যতের শক্তি উৎস

ভূমিকা
বর্তমান বিশ্ব শক্তির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো প্রচলিত জ্বালানী সীমিত এবং পরিবেশ দূষণের কারণ। তাই বিজ্ঞানীরা একটি নিরাপদ, পরিষ্কার ও অশেষ শক্তি উৎস হিসেবে নিউক্লিয়ার ফিউশনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের শক্তি উৎপাদনের সম্ভাবনাময় একটি পথ।
নিউক্লিয়ার ফিউশন এবং নিউক্লিয়ার ফিশনের পার্থক্য
নিউক্লিয়ার ফিশন (Fission)
- নিউক্লিয়ার ফিশন হলো একটি ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙিয়ে ছোট ছোট নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া।
- উদাহরণ: ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম পরমাণুর ভাঙ্গন।
- এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি নির্গত হয়, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়।
- তবে, ফিশন প্রক্রিয়ার ফলে পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে বিপজ্জনক থাকে।
নিউক্লিয়ার ফিউশন (Fusion)
- নিউক্লিয়ার ফিউশন হলো দুই বা ততোধিক হালকা পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে একটি ভারী নিউক্লিয়াস গঠনের প্রক্রিয়া।
- উদাহরণ: হাইড্রোজেনের বিভিন্ন আইসোটোপ, যেমন ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম এর মিলন।
- এই প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত বেশি শক্তি মুক্তি পায়, যা সূর্যের শক্তির উৎস।
- ফিউশনের ফলে বর্জ্য হয় না বা খুবই কম এবং পরিবেশবান্ধব।
নিউক্লিয়ার ফিউশনের মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান
- পারমাণবিক বন্ধন শক্তি: হালকা নিউক্লিয়াসগুলো মিলিত হয়ে একটি ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করলে শক্তির মুক্তি ঘটে, কারণ নতুন নিউক্লিয়াসের বন্ধন শক্তি মোটের চাইতে বেশি।
- উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপের প্রয়োজন: নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটাতে প্লাজমা (তরল আয়নায়িত গ্যাস) অবস্থা অর্জন করতে হয় যেখানে তাপমাত্রা প্রায় ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হতে হয়।
- প্লাজমার নিয়ন্ত্রণ: এত উচ্চ তাপমাত্রায় কোন পদার্থই গলতে পারে না, তাই প্লাজমাকে চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
প্রধান গবেষণা প্রকল্পসমূহ
১. ITER (International Thermonuclear Experimental Reactor)
- একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় পরিচালিত বৃহত্তম ফিউশন গবেষণা প্রকল্প।
- ফ্রান্সে অবস্থিত এই রিঅ্যাক্টরটি টোকামাক (Tokamak) ডিজাইন ব্যবহার করে।
- লক্ষ্য: ফিউশন থেকে উৎপাদিত শক্তি ইনপুট শক্তির তুলনায় বেশিবার বেশি করা।
- প্রাথমিক পরীক্ষামূলক কাজ চলছে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. NIF (National Ignition Facility)
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস আলামোস ল্যাবে অবস্থিত।
- এটি লেজার ফিউশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যেখানে শক্তিশালী লেজার বিম প্লাজমাকে সংকুচিত করে ফিউশন ঘটানোর চেষ্টা করে।
- এই গবেষণায় বড় অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু এখনও বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব হয়নি।
নিউক্লিয়ার ফিউশনের সামনে প্রতিবন্ধকতা
- উচ্চ তাপমাত্রায় প্লাজমার নিয়ন্ত্রণ: এত বেশি তাপমাত্রা বজায় রাখা এবং প্লাজমাকে স্থিতিশীল রাখা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
- উপাদানের টেকসইতা: ফিউশন রিঅ্যাক্টরের ভেতরের অংশগুলো এই চরম পরিবেশে কতক্ষণ টিকে থাকবে, তা একটি বড় সমস্যা।
- অর্থনৈতিক ব্যয়: উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারের কারণে প্রকল্পের খরচ অত্যন্ত বেশি।
- ত্রিটিয়াম সরবরাহ: ফিউশনের প্রধান ইন্ধন ত্রিটিয়াম, যা খুবই বিরল এবং ক্ষয়শীল।
নিউক্লিয়ার ফিউশনের সুবিধা
- প্রচুর ও পরিষ্কার শক্তি: সূর্যের মতো ফিউশন থেকে মেগাওয়াট পরিমাণ শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
- কম বর্জ্য: ফিশনের মতো দীর্ঘমেয়াদী রেডিওঅ্যাকটিভ বর্জ্য তৈরি হয় না।
- পরিবেশ বান্ধব: কার্বন নির্গমন নেই, জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়ক।
- অমিত শক্তি উৎস: পৃথিবীর জল এবং লিথিয়ামের সাহায্যে ইন্ধন চিরস্থায়ী।
ঝুঁকি ও নিরাপত্তা বিষয়ক দিক
- ফিউশনের মধ্যে পারমাণবিক বিক্রিয়া হলেও, এটি ফিশনের মতো অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ বা চেইন রিএকশনের আশঙ্কা নেই।
- তবে, উচ্চ তাপমাত্রা ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা হলে প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- ত্রিটিয়াম ব্যবহারের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহার
নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তি ভবিষ্যতের শক্তি উৎপাদনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পথ। যদিও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, তবুও আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে আশার আলো জ্বালিয়েছে। পরিষ্কার, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ শক্তির জন্য নিউক্লিয়ার ফিউশন আগামী দিনে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
নিউক্লিয়ার ফিউশন, পারমাণবিক শক্তি, ফিউশন বনাম ফিশন, ITER প্রকল্প, NIF লেজার ফিউশন, ভবিষ্যতের শক্তি, পরিষ্কার শক্তি, পরিবেশ বান্ধব শক্তি, পারমাণবিক শক্তির ঝুঁকি
নিউসলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন
আপডেট পান আমাদের সর্বশেষ বিজ্ঞান আর্টিকেল এবং খবর নিয়ে সরাসরি আপনার ইনবক্সে।